হাওজা নিউজ বাংলা রিপোর্ট অনুযায়ী, পর্ব ৩- বিরুদ্ধবাদীদের নিকট ইমামের যুক্তি প্রমাণ পেশ
আলী (আ.)-এর আবদুল্লাহ্ বিন নাফে নামক এক শত্রু ছিল। সে বলত যদি এই পৃথিবীর কেউ আমাকে বোঝাতে পারে যে খারেজীদেরকে হত্যা করে আলী সঠিক কাজ করেছে তবে আমি তার পক্ষে যাব। যদিও সে পৃথিবীর পূর্বে ও পশ্চিমে অবস্থান করে।
কেউ তাকে বলল : তুমি কি মনে কর যে আলী (আ.)-এর সন্তানরাও এটাকে প্রমাণ করতে পারবে না?
নাফে : তার সন্তানদের মধ্যে কি কেউ এমন মনীষী আছে যে আমাকে বোঝাতে পারে?
বলল : এটাই তোমার মুর্খতার একটা বড় পরিচয়। আর এটা কি সম্ভব যে আলী (আ.)-এর সম্ভ্রান্ত বংশে কোন মনীষী থাকবে না?
নাফে : এখন তার বংশের মনীষী কে?
ঐ ব্যক্তি তার কাছে ইমাম বাকের (আ.)-এর পরিচয় তুলে ধরল। সে তার সঙ্গী সাথিদের নিয়ে মদীনায় এসে ইমামের সাথে দেখা করার জন্য অনুমতি চাইল...।
ইমাম তার মালামালগুলিকে উটের পিঠ থেকে নিচে নামানোর জন্য এক ভৃত্যকে নির্দেশ দিলেন। আর তাকে পরের দিন ইমামের কাছে উপস্থিত হতে বললেন।
পরের দিন সকালে আবদুল্লাহ্ তার সাথিদের সহ ইমামের বৈঠক খানায় আসল। এদিকে তিনি নিজের সন্তানদের,মুহাজির ও আনসারদের উত্তরসূরীদেরকেও ঐ বৈঠকে উপস্থিত হতে নির্দেশ দিলেন। যখন সবাই সেখানে জমা হলো। ইমামের গায়ে তখন লাল বর্ণের একটি পোশাক ছিল। ফলে তাঁকে দেখতে আকর্ষণীয় ও সুদর্শন লাগছিল। তিনি বললেন : মহান আল্লাহর অশেষ প্রশংসা। যিনি স্থান,কাল,পাত্র সকল কিছুর সৃষ্টিকর্তা। প্রশংসা সেই আল্লাহ্ তায়ালার,যার না নিদ্রা আছে,না নিদ্রার ভাব। আর যা কিছু এই আসমান ও জমিনে আছে তিনি এ সব কিছুরই মালিক...। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি এই যে,আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কোন মা’বুদ নেই এবং মুহাম্মদ (সা.) সৃষ্টির মধ্য হতে বাছাইকৃত তাঁর বান্দা ও রাসূল। কৃতজ্ঞতা মহান আল্লাহর যিনি তাঁকে নবুওয়াত দান করে আমাদেরকে সম্মানিত করেছেন। আর আলী (আ.)-কে তাঁর নবী (সা.)-এর খলিফা নিযুক্ত করে আমাদেরকে বিশিষ্ট করেছেন।
হে মুহাজির ও আনসারদের সন্তানেরা! তোমাদের মধ্য থেকে যে যতটুকুই আলী বিন আবি তালিবের মর্যাদা সম্বন্ধে জান বল। উপস্থিতদের মধ্য থেকে একজন আলী (আ.)-এর মর্যাদা ফজিলত বর্ণনা করতে করতে খাইবারের হাদীসে পৌঁছে,বলল : নবী (সা.) খাইবারের ইহুদীদের সাথে যুদ্ধের সময় বলেছিলেন :
(لَاُعْطِيَنَّ الرَّايَةَ غَداً رَجُلاً يُحِبُ اللَّهَ وَ رَسُولَهُ وَ يُحِبُّهُ اللَّهُ وَ رَسُولُهُ,كَرَّاراً غَيْرَ فرَّار لاَ يَرْجِعُ حَتَّى يَفْتَحَ اللَّهُ عَلى يَدَيْهِ )
আগামীকাল ইসলামের পতাকা এমন একজনের হাতে দিব যে আল্লাহ্ ও তাঁর নবীকে ভালবাসে এবং আল্লাহ্ ও তাঁর নবীও তাকে ভালবাসে। যুদ্ধ পারদর্শী যে কখনও যুদ্ধ থেকে পলায়ন করে না এবং আগামীকাল যুদ্ধ থেকে খালি হাতে ফিরে আসবে না যতক্ষণ পর্যন্ত না আল্লাহ্ তাঁর হাতে ইহুদীদের পরাজয় ঘটান।
পরের দিন ইসলামের পতাকাটিকে আমিরুল মুমিনীন আলী (আ.)-এর হাতে দিলেন। তিনি যুদ্ধে বিস্ময় সৃষ্টি করে ইহুদীদেরকে পরাজিত ও পলায়নে বাধ্য করলেন। আর তাদের বৃহৎ দুর্গের দরজাকে খুলে ফেললেন।
ইমাম বাকের (আ.) আবদুল্লাহ্ বিন নাফেকে বললেন : এই হাদীসের ব্যাপারে তোমার ধারণা কি?
নাফে : হাদীসটি সত্য কিন্তু আলী পরে কাফের হয়ে গিয়েছিল এবং খারেজীদেরকে অন্যায়ভাবে হত্যা করেছে।
ইমাম : তোমার জন্য তোমার মাকে ক্রন্দন করা উচিত। আল্লাহ্ যখন আলীকে ভালবাসতেন তখন তিনি কি জানতেন না যে সে খারেজীদেরকে হত্যা করবে? যদি বল আল্লাহ্ জানতেন না কাফের হয়ে যাবে।
নাফে : আল্লাহ্ জানতেন।
ইমাম : আল্লাহ্ তাঁকে কি তাঁর নির্দেশ মেনে চলার জন্য ভালবাসতেন নাকি তাঁর নির্দেশ অমান্য করে চলার কারণে?
নাফে : যেহেতু সে আল্লাহর নির্দেশ মেনে চলত সে কারণেই আল্লাহ্ তাকে ভালবাসতেন (অর্থাৎ যদি ভবিষ্যতে সে পাপী হয়ে যেত তাও আল্লাহ্ জানতেন এবং কখনও তাকে ভালবাসতেন না,সুতরাং এটা পরিষ্কার যে খারেজীদেরকে হত্যা করা আল্লাহর আনুগত্যের মধ্যেই হয়েছিল)।
ইমাম : তুমি চলে যাও পরাজিত হয়েছো,কারণ এ ব্যাপারে তোমার কাছে কোন জবাব নেই। আবদুল্লাহ্ উঠে যাওয়ার সময় এই আয়াতটি তেলাওয়াত করল :
) حَتًّى يَتَبَيَّنَ لَكُمُ الْخَيْطُ الْاَبْيَضُ مِنَ الْخَيْطِ الْاَسْوَدِ مِنَ الْفَجْرِ(
যতক্ষণ পর্যন্ত না তোমাদের না তোমাদের কাছ থেকে সুবহে সাদেকের সাদা রেখা,কাল রেখা হতে পৃথক হয়ে যায়।২০
এ বিষয়টিকে রাতের অন্ধকার ঠেলে দিনের আলোর মত পরিষ্কার হয়ে যাওয়ার দিকে ইশারা করে বলল : আল্লাহ্ই ভাল জানেন যে তাঁর রিসালতের দায়িত্ব কোন পরিবারের উপর ন্যস্ত করবেন।২১
ইমামের নির্দেশে ইসলামী মুদ্রার প্রচলন ২২
হিজরী শতাব্দীর প্রথম দিকে কাগজ শিল্প রোমানদের হাতে ছিল। মিশরের খৃস্টানরাও রোমানদের নীতিকৌশল অবলম্বন করেই কাগজ তৈরী করত। আর তাতে খৃস্টানদের বিশ্বাস অনুযায়ী ত্রিত্ববাদ ইঙ্গিতকারী বিশেষ চিহ্ন সংযোজন করত। উমাইয়্যা শাসক আবদুল মালেক ছিল অতি চালাক প্রকৃতির। এই ধরনের কাগজ দেখে তার উপর সংযোজনকৃত চিহ্নটির ব্যাখ্যা দেয়ার জন্য নির্দেশ দিল। যখন তার প্রকৃত অর্থ বুঝতে পারল অত্যন্ত রাগান্বিত হল। এ কারণে যে মিশর একটি ইসলামী রাষ্ট্র। আর এ রাষ্ট্রে ব্যবহৃত শিল্পজাতদ্রব্যে এ ধরনের প্রতীক থাকবে এটা হতে পারে না। সাথে সাথে মিশরের গভর্ণরকে নির্দেশ দিল যে এ ধরনের কাগজগুলিকে নষ্ট করে তার স্থানে তৌহিদের শ্লোগান شَهِدَ اللَّه اَنَّهُ لاَ اِلَهَ الاَّ هُو. সম্বলিত কাগজ তৈরি করতে। আর পার্শ্ববর্তী সব ইসলামী প্রদেশগুলিকেও খৃস্টানদের অংশীবাদী বিশ্বাসের প্রতীক সম্বলিত কাগজ নষ্ট করে ফেলে নতুন কাগজ ব্যবহারের জন্য নির্দেশ পাঠাতে বলল।
তৌহিদী উক্তি সম্বলিত কাগজের ব্যবহার বেশ প্রচার পেল। সেই কাগজ রোমের বিভিন্ন শহরেও পৌঁছাল। এই খবর রোমের সম্রাটের কাছে পৌঁছালে সে আবদুল মালেকের কাছে এ মর্মে একটি চিঠি পাঠাল : কাগজের মুদ্রা সর্বদা খৃস্টানদের প্রতীক সম্বলিত ছিল। তা পাল্টানোর সিদ্ধান্ত যদি তোমার হয়ে থাকে,তাহলে তোমার আগের খলিফারা ভুল করেছে। আর যদি তারা ঠিক করে থাকে তাহলে তুমি ভুল করছো।২৩ আমি এই চিঠির সাথে তোমার জন্য উপযুক্ত উপঢৌকন পাঠালাম যেন তাতে তুমি সন্তুষ্ট হও। আর প্রতীক সম্বলিত কাগজের প্রচলন যেন আগের মতই থাকে। জবাব হ্যাঁ সূচক হলে তোমার প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতা থাকবে। আবদুল মালেক উপঢৌকন সামগ্রী গ্রহণ করল না এবং রোমের সম্রাটের বিশেষ দূতকে বলল : এই চিঠির কোন উত্তর নেই।
আবদুল মালেকের কাছে রোমের বাদশার পক্ষ থেকে দ্বিতীয়বারের মত দ্বিগুণ পরিমান উপঢৌকন প্রেরিত হলো। তার সাথে আরও একটি চিঠি পাঠাল : আমার মনে হয় উপঢৌকন সামগ্রী অল্প হওয়াতে তুমি গ্রহণ করনি। এখন দিগুণ পরিমানে পাঠালাম আশা করব যে এই উপঢৌকনের কারণে তোমার কাছে আমার আগের চাওয়া বিষয়টিও গ্রহণযোগ্যতা পাবে। আবদুল মালেক প্রথমবারের ন্যায় এবারও উপহার সামগ্রী গ্রহণ করল না এবং চিঠির জবাবও দিল না।
রোমের সম্রাটের পক্ষ থেকে আবার আবদুল মালেকের কাছে চিঠি আসল : দুইবার আমার পাঠানো উপহার গ্রহণ করলে না। আমার ইচ্ছাও পূর্ণ করলে না। তৃতীয়বারের মত কয়েকগুণ বেশি উপঢৌকন পাঠালাম। ঈসার কসম যদি প্রতীক সম্বলিত কাগজের ব্যবহার আগের পর্যায়ে ফিরিয়ে না আন তাহলে নবী মুহাম্মদের নামের সাথে অপমানকর বাক্য সম্বলিত স্বর্ণ ও রোপ্য মুদ্রা তৈরী করার নির্দেশ দেব। আর তুমি তো এটা ভাল করেই জান যে রোমানরা মুদ্রা তৈরীতে বিশেষ পারদর্শী। যখন তোমরা তোমাদের নবীর নামে অপমানকর বাক্য সম্বলিত মুদ্রাগুলি দেখবে তখন লজ্জায় তোমাদের কপাল ঘামে ভিজে যাবে। সুতরাং এটাই ভাল যে উপঢৌকনগুলি গ্রহণ করে আমাদের ইচ্ছাটিকে পূরণ কর। যেন আমাদের অতীতের বন্ধুত্ব আগের মতই থাকে।
আবদুল মালেক তার চিঠির জবাবে উপায়হীন হয়ে বলল আমার ধারণা এটাই যে,মুসলমানদের মধ্যে যদি কোন নিকৃষ্ট ব্যক্তি জন্ম গ্রহণ করে থাকে আমিই সেই ব্যক্তি। কেননা আমিই এই কাজের কারণ হয়েছি যে রাসূল (সা.)-কে অবমাননা করবে। মুসলমানদের সাথে আলোচনা করল কিন্তু কেউ কোন উপায় বের করতে পারল না। তাদের একজন বলল : তুমি নিজেও এর উপায় জান কিন্তু ইচ্ছাকৃতভাবে সে উপায়কে গ্রহণ করছো না।
আবদুল মালেক : এই হতভাগা,তুমি বলছো আমি সে উপায়টি জানি। কিন্তু সেটা কি?
বলল : নবী পরিবারের বাকেরের কাছ থেকে থেকে এই সমস্যার সমাধান চাও,অবশ্যই তিনি এর সমাধান দিতে পারবেন।
আবদুল মালেক তার কথাকে মেনে নিল। ইমাম বাকের (আ.)-কে অত্যন্ত সম্মানের সাথে সিরিয়ায় পাঠানোর জন্য মদীনার গভর্ণরকে নির্দেশ পাঠাল। রোমের সম্রাটের পাঠানো বিশেষ দূতকে ইমাম আসা পর্যন্ত সেখানেই রেখে দিল। ইমাম শামে(সিরিয়ায়) এলে তার কাছে ঘটনার বর্ণনা দিলে তিনি বললেন :
নবী (সা.)-এর অবমাননার ব্যাপারে রোমের সম্রাটের পক্ষ থেকে যে হুমকি এসেছে তা বাস্তবায়িত হবে না। কেননা আল্লাহ্ এই কাজ তাকে করতে দিবেন না। আর এই সমস্যার সমাধানের পথও অত্যন্ত সহজ। এখন সমস্ত শিল্পীদেরকে এক জায়গায় একত্রিত কর যেন তারা মুদ্রা তৈরীর কাজে লাগতে পারে। মুদ্রার এক পিঠে সূরা ইখলাছ ও অন্য পিঠে নবী (সা.)-এর নাম লেখ। আর এভাবেই আমরা রোমানদের ধাতবমুদ্রা থেকে অমুখাপেক্ষী হবো। মুদ্রার ওজন সম্পর্কেও তিনি এভাবে ব্যাখ্যা দেন যে,দশ দেরহাম করে তিন ধরনের মুদ্রা তৈরী করবে যার প্রতিটির ওজন হবে সাত মিসকাল।২৪ তিনি আরও বললেন,যে শহর থেকে মুদ্রা তৈরী করা হবে সে শহরের নাম,তারিখ ও বছর যেন তাতে উল্লেখ করা হয়।
আবদুল মালেক ইমামের নির্দেশকে বাস্তবায়ন করল এবং প্রতিটি ইসলামী প্রদেশগুলিতে সংবাদ পাঠাল যে সব ধরনের বেচা-কেনাতে যেন নতুন মুদ্রা ব্যবহার করা হয়। এখনও যাদের কাছে আগের মুদ্রা আছে ফেরত দিয়ে তাদেরকে ইসলামী মুদ্রা গ্রহণ করার জন্য জানাল। আর সম্রাটের বিশেষ দূতকে এ বিষয়ে অবগত করে পাঠিয়ে দিল।
সম্রাটকে এই ঘটনা সম্বন্ধে অবগত করা হলো। দরবারের লোকেরা তাকে আবদুল মালেককে দেয়া অতীতের হুমকিকে কার্যে পরিণত করার জন্য অনুরোধ জানালে সে বলল : আমি শুধুমাত্র তাকে রাগাতে চেয়েছিলাম মাত্র। কিন্তু এ কাজ এখন অনর্থক কেননা ইসলামী দেশগুলিতে এখন আর রোমান মুদ্রার ব্যবহার হবে না।২৫ …চলবে…